প্রতিটন বর্জ্যে ১৩শ’ লিটার ডিজেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন হবে
প্রতিটন বর্জ্যে ১৩শ’ লিটার ডিজেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন হবে
# প্রতি লিটার ডিজেলের উৎপাদন মূল্য পড়বে সর্বোচ্চ ২০ টাকা
# জ্বালানি আমদানি কমে যাবে, ক্লিন বাংলাদেশ গঠনেও ভূমিকা রাখবে এই প্লান্ট
প্লাস্টিক ও পলিথিনসহ অব্যবহৃত বর্জ্য থেকে জ্বালানি (ডিজেল, জেট ফুয়েল, এলপিজি গ্যাস) উৎপাদনের মেশিনারিজ আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞানি ড. মইন উদ্দিন সরকার বাদল ও ড. আনজুমান সেলী। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী দুই বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কারের ফলে যেমন ঢাকাসহ সারাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে তেমনি খুব অল্প খরচে জ্বালানি উৎপাদন করে বাজারের চলমান চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব হবে। তাদের আবিষ্কৃত মেশিনারিজ (যন্ত্রপাতি) দিয়ে বাংলাদেশে প্লান্ট (বর্জ্য থেকে জ্বালানি) তৈরি করতে চান। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি তথা ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই বিজ্ঞানি দম্পত্তি।
একটি প্লান্ট স্থাপনে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার প্রয়োজন পড়বে। দুই বছরের মধ্যেই এই পরিমাণ টাকা উঠে আসবে বলে দাবী এই বিজ্ঞানী দম্পত্তির।
গত দুইদিন ধরে এই দুই বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নিয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সোমবার এ নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনেও তাদের আবিষ্কারের বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
বিজ্ঞানি ড. মইনউদ্দিন সরকার জানান, বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে পরে থাকা কোনো কিছুই ফেলনা নয়। প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে শুরু করে অব্যবহৃত বর্জ্যগুলো থেকে প্রতিটন বর্জ্যে ১৩শ’ লিটার ডিজেল, ১০টি সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার অ্যাভিয়েশন বা জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে পরিবেশ বান্ধব রেখে তাদের আবিষ্কৃত যন্ত্র দিয়ে প্লান্ট স্থাপন করে জ্বালানি তৈল উৎপাদন করা সম্ভব। এই প্লান্ট থেকে উৎপাদিত প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পড়বে ২০ টাকা। আর জেট ফুয়েল ও সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস উৎপাদন এই খরচেই হয়ে যাবে। এ প্লান্ট স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সহযোগীতা ও বিনিয়োগের প্রয়োজন।
ড. মইনউদ্দিন বলেন, পৃথিবীতে দিনে দিনে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে, সেই সঙ্গে আমাদের চারপাশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য। যা হয়ে ওঠেছে আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্লাস্টিক পচনশীল নয় বিধায় মাটি হারাচ্ছে তার উর্বর শক্তি। খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে। ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাষন ব্যবস্থা রোধ হচ্ছে ফলে মশা-মাছির প্রকোপ বেড়েই যাচ্ছে এবং বৃষ্টি হলে শহরে নৌকা চালাতে হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের প্রাদুর্ভাবে বন ও জলজ জীব বৈচিত্র ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই বিজ্ঞানীর দেওয়া তথ্যমতে, শুধু আমেরিকাতেই প্রতিবছর ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় যার মাত্র ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪.৮ বিলিয়ন পাউন্ড পূণঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৮ মিলিয়ন মেট্রিকটন মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়াস্ট (এমএস ডব্লিউ) বর্জ্য উৎপাদন হয়, যার মধ্যে ১৫ শতাংশই প্লাস্টিক অর্থাৎ ৪.২মিলিয়ন প্লাস্টিক। যার মাত্র ১০ শতাংশ পূণঃপ্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাবিশ্বে প্রায় ৬.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে, যার মাত্র ৯ শতাংশ পুণঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ সক্ষম হয়েছে।
ড. মইন উদ্দিন সরকার ও ড. আনজুমান সেলী ডিআরইউতে নিজেদের গবেষণা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন বর্জ্যপ্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই বর্জ্য প্লাস্টিকের সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০৫ সাল থেকে আমি ও আমার সহকর্মী (স্ত্রী) ড. আনজুমান সেলী গবেষণা শুরু করি। ২০১০ সালে প্লাস্টিক থেকে তেল উৎপাদনের একটি প্রযুক্তি ও তার পেটেন্ট তৈরি করি। যা নবায়নযোগ্য শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় দুই দশক গবেষণার পর আমরা সাফল্যের সাথে একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হই, যার প্রতি টন পরিত্যাক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে ১৩শ’ লিটার জ্বালানি তেল, ১০ সিলিন্ডার এল.পি.জি গ্যাস এবং ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন করা সম্ভব।
ড. সরকার আরও বলেন, ‘নিজের গবেষণার সাফল্যেকে বাস্তব রুপ দিতে আমরা আমেরিকায় নিউইয়র্কের ব্রিজপোর্ট ও নিউজার্সিতে প্লান্ট গড়ে তুলেছি। পরিত্যাক্ত প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলছি। উৎপাদন কোম্পানির নাম ওয়াস্ট টেকনোলজিস এলএলসি, আমেরিকা (Waste Technologies LLC) । বর্তমানে কোম্পানিটি বাংলাদেশেও এ রকমের প্লান্ট করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই কেন্দ্র স্থাপন হলে একাধারে যেমন দেশকে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি দেশের স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত যুুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। তখন আর হয়তো বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বাড়ানো যাবে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত হিসেবে তারা এই দেশকেই গুরুত্ব দেন তাই। এশিয়ার বর্জ্য প্লাস্টিক পূনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের হাব হিসেবে (কেন্দ্র) পরিচিতি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে দেশের আলাদা একটি জায়গা করে দিতে চান এই দুই বিজ্ঞানী।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় ড. মইনউদ্দিন সরকার বাদল বলেন, প্লাস্টিক ছাড়া বর্তমান পৃথিবীর কথা ভাবা যায় না। একুশ শতকে পৃথিবীর ব্যাপক পরিবর্তন মানুষকে প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলেছে। তারা নিয়মিতভাবে সহজলভ্য প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, বিশ শতকে পৃথিবীতে উৎপাদিত হয়েছে ৬০০ কোটি টন প্লাস্টিক। যে প্লাস্টিক মানুষ ব্যবহার করে তা পরিবেশের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। কারণ প্লাস্টিকের ক্ষয় হয় না, নষ্ট হয় না। ড্রেন, নালা, শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যের ঝুঁকি মোকাবেলা ও বিকল্প জ্বালানি তৈরি নিয়ে আমরা গবেষণা শুরু করি। আমরা সফল হয়েছি। প্লাস্টিক আসলে এক ধরনের অশোধিত তেল। এ তেল ঠান্ডা করে যে কোনো আকৃতি দেয়া যায় ও সংরক্ষণ করা যায়। এর একটি অংশ দিয়ে শপিং ব্যাগ, পাত্র, খেলনা ও নানা রকমের শো-পিস তৈরি করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেসব বাধা অতিক্রম করেছি।
বিজ্ঞানি দম্পত্তি ড. মইনউদ্দিন সরকার বাদল ও আনজুমান আরা সেলীর কোম্পানি ওয়েস্ট টেকনোলজিস এলএলসি, আমেরিকা-এর উৎপাদিত তেলের নাম এনএসআর ফুয়েল। ড. সরকার এ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানীদের প্রধান। আনজুমান আরা প্রতিষ্ঠানের কো-ফাউন্ডার ও নির্বাহী পরিচালক। এনএসআর ফুয়েলের বিশেষত্ব এটি পরিবেশবান্ধব। এতে অতি সামান্য সালফার থাকবে। অন্য যারা ডিজেল তৈরি করছে সেখানে সালফারে পরিমাণ অনেক বেশি। সালফার থাকার কারণে এগুলো যখন ব্যবহার হচ্ছে তখন বাতাসে সালফার-ড্রাই-অক্সাইড ছড়াচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে উৎপন্ন ৯৫ শতাংশ তেল, বাকি ২ ভাগ হালকা গ্যাস, ২ ভাগ সিস্টেম লস। এ প্রক্রিয়ায় কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট থাকবে না বলে দাবি করেন তিনি।
মইনউদ্দিন সরকার বাদল ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি পাস করে বিদেশে পাড়ি জমান। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের ম্যানচেস্টার ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পি. এইচ. ডি অর্জন করেন। প্রায় একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান আনজুমান আরা সেলী। দীর্ঘ ২৮ বছর যাবত গবেষক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন ড. সরকার। জন্মসূত্রে মইনউদ্দিন সরকার বাদল কুমিল্লা ও ড. আনজুমান আরা সেলী বরিশালের বাসিন্দা।
ড. আনজুমান আরা সেলী বলেন, এ ধরনের প্লান্ট স্থাপন করা হলে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে যেমন রক্ষা পাবে. তেমনি হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিজ্ঞানি ড. মইনউদ্দীন সরকার বাদল ও আনজুমান আরাকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রেনেওয়াবেল এনার্জি ইনোভেটর অব দ্য ইয়ারে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এছাড়া তারা একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেছেন।